বিলুপ্তির পথে মধুপুরের আমবাড়িয়া জমিদারবাড়ি
মো. নজরুল ইসলাম, বিশেষ প্রতিনিধি:
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় সামন্তযুগের সব প্রত্নতত্ত্ব ও পুরাকীর্তি নানা অবহেলা ও অযত্নের ফলে বিলুপ্তির পথে। প্রত্নতত্ত্বহলো ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য উৎস। সোনালি অতীত ছাড়াও এটি সমসাময়িক মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও জীবনসংগ্রামের শেকড় হিসেবে বিবেচিত হয়।
জানা গেছে, পুকুরিয়া পরগনার জমিদার পদ্মলোচন রায় ১৮৩১ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া মৌজায় বংশাই নদীর ডান তীরে ছয় একর জায়গা জুড়ে নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন বিশাল রাজবাড়ি।বৈঠকখানাসহ রাজবাড়িতে থাকার ঘর ছিল ৫১টি। বাড়ির পূর্ব পাশে ছিল বিশাল শিবমন্দির। সঙ্গেই ছিল তহশিল কাচারি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। রাজবাড়ির দক্ষিণ পাশে ছিল ফুল ও ফলের বাগান। সেই বাগান পেরিয়ে বংশাই নদীর ঘাটে ছিল শানবাঁধানো প্রশস্ত রাজঘাট। ঘাটের পাশেই শিবমন্দির। রাজঘাট ও শিবমন্দির এখনো কোনোরকমে টিকে আছে। আর ইন্দো-ভারতীয় স্থাপত্য রীতিতে ইট, চুন-সুরকি আর লোহার বিমের ওপর নির্মিত রাজবাড়ির উত্তর অংশ ছিল দ্বিতল। বাড়ির মূল ফটকের পাশেই ছিল দুর্গামন্দির। আর ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলেই মিলত দরবার হল।
পদ্মলোচন মারা গেলে তার ছেলে কালীচন্দ্র রায় ১২৬১ সালে পুখুরিয়া পরগনার জমিদার ভৈরবচন্দ্রের ছয় আনা তালুক কেনেন। কালীচন্দ্র মারা গেলে ছেলে হেমচন্দ্র রায় মুক্তাগাছার মহারাজা সূর্যকান্ত রায়ের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে জয়েনশাহী পরগনার নিলাম হওয়া তালুকের পাঁচ আনা আড়াই গন্ডা ক্রয় করেন। এভাবে উত্তর টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিশাল এলাকায় জমিদারি বিস্তৃত হওয়ায় হেমচন্দ্র রায় থেকে হন চৌধুরী।
ধনবাড়ির মুসলিম জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর সঙ্গে রাজকাচারি, প্রজাস্বত্ব এবং মৌজার সীমানা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৮০ সালে আমবাড়িয়া রাজবাড়ি ত্যাগ করে গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের সুবর্ণখালী গ্রামে প্রথম ও দ্বিতীয়বার শিমলাপাড়া মৌজায় পরী দালাল নামে হেমনগর রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। এভাবে আমবাড়িয়া রাজবাড়ি জৌলুস হারাতে থাকে।
তবে দেশভাগের পর হেমচন্দ্র চৌধুরীর উত্তরসূরিরা দেশ ত্যাগ করলে আমবাড়িয়া রাজবাড়ী লুটপাটের শিকার হয়। প্রভাবশালীরা বাড়ির জানালা ও দরজা থেকে শুরু করে সব আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায়। কেউ কেউ মূল ভবনের অংশ ভেঙে ইট ও লোহার বিম খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজবাড়ির দেওয়াল ভেঙে প্রায় কালীমন্দিরসহ ছয় একর জায়গা জবরদখল করে নেওয়া হয়। পরে জবরদখল করা কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করে স্থানীয় প্রশাসন সেখানে গুচ্ছগ্রাম গড়ে তোলে। রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে রাজবাড়ির মূল ভবনের এখন জীর্ণদশা। ভগ্নদশা নিয়ে ৩০ কক্ষ নিয়ে বাড়িটি কোনোভাবে টিকে রয়েছে। স্থানীয় কিছু লোকজন বাড়িটির ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে একটি মন্দির এবং হেমচন্দ্র চৌধুরীর নামে একটি বৃদ্ধনিবাস স্থাপন করেছে। এখানে জনাদশেক অসহায় প্রবীণ মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন।
বৃদ্ধনিবাসের প্রতিষ্ঠাতা হারাধন দাস ও প্রিয়াঙ্কা ঘোষ মৌ জানান, রাজবাড়িটিও জবরদখল হয়ে যাচ্ছিল। বৃদ্ধনিবাস স্থাপন করে দখল বন্ধ করা গেছে। তারা এ বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বৃদ্ধনিবাসের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দাবি জানান।
এদিকে ইংরেজ শাসনামলে পৌর শহরের বোয়ালী গ্রামের গজারী জঙ্গল ছিল সন্ন্যাসী আন্দোলনের সূতিকাগার। সন্ন্যাসীরা বোয়ালীর জঙ্গলকে ঘাঁটি করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন, সেটি দমনের জন্য ১৭৮৭ সালে ময়মনসিংহকে জেলা ঘোষণা করা হয়।
মধুপুর শহরের বংশাই নদীর ডান তীরে বোয়ালী গ্রামে মিনি দুর্গ, মন্দির এবং নদীর বাঁ তীরে সন্ন্যাসীরা সুউচ্চ মঠ তৈরি করে। বঙ্কিমচন্দ্র ময়মনসিংহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাবস্থায় মধুপুরের সন্ন্যাসী আন্দোলনকে উপজীব্য করে বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ লেখেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী আনন্দমঠের সুউচ্চ মঠটি কামান দেগে ধ্বংস করে। বোয়ালী গ্রামে সন্ন্যাসীদের কোনো কোনো স্থাপত্য নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত অস্তিত্বমান ছিল। মধুপুর পৌরসভা হওয়ার পর সন্ন্যাসীদের স্মৃতিবিজড়িত পুরাকীর্তি অবাধে ধ্বংস করা হয়।
মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীমা ইয়াসমীন জানান, তিনি এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন এবং সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবেন।
No comments