মধুপুর স্ক্যামারদের স্বর্গরাজ্য! ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রতারণা - TangailTimes24
  • সংবাদ শিরোনাম

    মধুপুর স্ক্যামারদের স্বর্গরাজ্য! ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রতারণা

    মো. নজরুল ইসলাম :


    টাঙ্গাইলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে অনলাইন স্ক্যামিং প্রতারণার ব্যবসা দিনদিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মধুপুর উপজেলা এখন স্ক্যামারদের স্বর্গরাজ্য। স্থানীয় প্রশাসন এসব সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে যেমন রেমিট্যান্স আসে তেমনি লাখো যুবকের কর্মসংস্থান হয়। তাই সরকার এ বৈধ পেশাকে নানাভাবে উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু স্ক্যামিং অনলাইন একটি প্রতারণামূলক অবৈধ ব্যবসা। টিনএজার পর্নো, এডাল্ট সাইট এবং ডেটিং সাইট নিয়ে স্ক্যামাররা কাজ করে থাকে। এক ধরনের অন্ধকার জগতের পেশা। আর এ পেশায় যৌনতা নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। 

    ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রতারণা
     

    স্থানীয়রা জানান, মধুপুর উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার কিশোর ও তরুণ নিষিদ্ধ অনলাইন স্ক্যামিংয়ে জড়িত। সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ডলার কামানোর ধান্ধায় এখন গৃহবধূসহ স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও এতে যোগ দিচ্ছে। স্ক্যামিং যেমন নব্য ধনকুবের তৈরি করছে, তেমনি এতে মাদক, জুয়াসহ নানা সামাজিক ব্যাধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পুলিশ মাসোহারা নিয়ে এসব অবৈধ ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন।


    আইটি বিশেষজ্ঞ তৌফিক-ই- হাসেম শরীফ জানান, স্ক্যামাররা সাধারণত আমেরিকান মডেল, পর্নোস্টার বা এসকর্টদের নগ্ন ছবি, ভিডিও বা নানা তথ্য ওয়েবসাইট থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে এডাল্ট ডেটিং সাইটে আইপি হাইড করে পোস্ট দেয়। এরপর টেক্সনাউ নামের ভার্চুয়াল নম্বর সার্ভিসের মাধ্যমে স্ক্যামাররা এসকর্ট সেজে হাজির হয়। যাদের এসকর্ট সার্ভিস দরকার সেই ট্রাফিকরা (গ্রাহক) নক করলে এসকর্ট সাজা স্ক্যামাররা ব্যক্তিগত সময় কাটানোর জন্য ট্রাফিকের সঙ্গে ডলার নিয়ে দর কষাকষি শুরু করে। নগ্ন ছবি ও ভিডিও শেয়ারের পরও অনেক গ্রাহক ভিডিও বা ভয়েস কলে রিয়েল পার্সন ভেরিফাই করতে চায়। রোবট সফটওয়্যার দিয়ে ভয়েস বা ভিডিও কল ভেরিফিকেশনেও গ্রাহকরা সন্তুষ্ট না হলে ভাড়াটে নারীদের হাজির করে স্ক্যামাররা। এসব নারী স্বল্প আলোতে ন্যুড হয়ে প্রলুব্ধ করে গ্রাহকদের। এরপর গ্রাহকের কাছ থেকে কিছু ডলার অ্যাডভান্স নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। স্ক্যামাররা এসব ডলার রিসিভ করে বিভিন্ন ক্যাশ অ্যাপ, কার্ড বা বিট কয়েনের মাধ্যমে। এরপর বিশেষ কায়দায় ডিজিটাল পেমেন্ট সার্ভিসের অ্যাকাউন্ট খুলে ডলার বিট কয়েনে কনভার্ট করে বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তরিত করে। 


    মধুপুরে একজন স্ক্যামার জানান, অভিজ্ঞ স্ক্যামাররা গ্রাহকদের সঙ্গে চ্যাট করে ব্যক্তিগত তথ্য, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এসএসএস উইথ সেলফি সংগ্রহের পর বিশেষ কায়দায় ট্রাফিকের ক্রেডিট কার্ডের সমুদয় ডলার হাতিয়ে নেয়। স্ক্যামার রনি সরকার জানান, ডেটিং স্ক্যাম ছাড়াও স্ক্যামাররা আমেরিকায় সম্পত্তি কেনাবেচা, বাড়ি ভাড়া বা রিয়েল এস্টেট সাইটে গিয়ে ক্রেগলিস্ট অর্গানাইজেশনের আইপি হাইড করে লোভনীয় তথ্যে পোস্ট দেয়। আর একই কায়দায় অ্যাডভান্স ডলার নিয়ে কেটে পড়ে তারা। আমেরিকার জনপ্রিয় ক্লাসিফাইড সাইট ব্যাকপেজ ডটকম-এর আদলে মধুপুরের স্ক্যামাররা ক্লাসিফাইড ডেটিং সাইট তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। টু ব্যাকপেইজ ডটকম, ব্যাকলিস্ট টুয়েন্টিফোর ডটকম এবং স্কিপ দ্য গেইমস ডটকম সাইটগুলোর মালিক মধুপুরের কয়েকজন স্ক্যামার। এরা এখন শত কোটি টাকার মালিক। 


    সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন মধুপুর পৌর শহরের নয়াপাড়া ও মাস্টারপাড়া মহল্লায় অভিযান চালিয়ে পর্নো ও ডেটিং সাইট ব্যবহারের মাধ্যমে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে একজন স্ক্যামারকে ১২ লাখ টাকা আয় করার প্রমাণ পায়। মধুপুর ছাড়াও ঘাটাইল, গোপালপুর, ধনবাড়ী, কালিহাতী ও ভূঞাপুরে ছড়িয়ে পড়েছে স্ক্যামিং ব্যবসা। মধুপুরের একটি বেসরকারি আর্কিটেক্ট কনসালটেন্টের তথ্যে দেখা যায়, দেড় বছরে মধুপুর উপজেলায় তিন শতাধিক বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে যার প্রায় সবই স্ক্যামিং পার্টির। স্থানীয়ভাবে স্ক্যামারদের বলা হয় নেট ব্যবসায়ী। দুই বছর আগে যারা রিকশা চালাত, ইটভাটায় কাজ করত সেসব পরিবারের সদস্যরা এখন নিজের বহুতল ভবনে বসবাস করেন। দামি গাড়িতে চড়েন। অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শোরুম ও কারখানাও গড়ে তুলেছেন। বিজেডএম গ্রাফিকের কর্ণধার প্রযুক্তিবিদ আপেল মাহমুদ জানান, স্ক্যামারদের এখনই থামাতে না পারলে ফ্রিল্যান্সিং পেশার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আস্থার সংকটে পড়ে এ শিল্প ধ্বংস হবে। ফরেনাররা তখন কাজ দেবে না। 


    মধুপুরের ফ্রিল্যান্সার ওয়েভ ডেভেলপার সবুজ মিয়া জানান, তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ফাইভার থেকে ভালো আয় করছিলেন তারাও কুমতলবের ফাইভার থেকে স্ক্যামিংয়ে চলে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। মধুপুরের নকরেক আইটির কর্ণধার সুবীর নকরেক জানান, যেখানে বৈধ ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর আয় করা যায়, সেখানে স্ক্যামিংয়ের মতো প্রতারণামূলক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ার কোনো মানে নেই। এতে দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এটির একটি নেগেটিভ রেজাল্ট আসবে শিগগিরই। 


    গারোবাজারস্থ মধুপুর এগ্রো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইদ্রিস কাজাল জানান, আমি এক সময়ে অনলাইনে কাজ করতাম। যখন দেখলাম অবৈধভাবে কাজ করতে হয় তখন এ পেশা থেকে সড়ে পরলাম। তিনি জানান, পতিতালয়ের দেহব্যবসায়িদের টাকা যতটা হারাম তার চেয়ে বহুগুণ হারাম হলো অনলাইলে প্রতারণার ব্যবসার টাকা


    শোলাকুড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী জানান, অনলাইন স্ক্যামিংয়ের টাকা এখন হাওয়ায় উড়ছে। এক শ্রেণির কিশোর ও যুবকের হাতে অঢেল অর্থ আসায় মাদক, জুয়াসহ নানা অসামাজিক কাজ বেড়ে যাওয়ায় সমাজে ভারাসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। 


    মধুপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদ হোসেন জানান, এসব বন্ধে পুলিশ কাজ করছে।
    উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা ইয়াসমিন পরিস্থিতির সত্যতা স্বীকার করে জানান, অবৈধ স্ক্যামিং ব্যবসার কাঁচা টাকায় ভয়াবহ মাদকের প্রসার ঘটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গিয়ে প্রতারণামূলক এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ছয় স্ক্যামারকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কিছু ভবন সিলগালা এবং স্ক্যামারদের যেন বাড়ি ভাড়া না দেওয়া হয় সেজন্য অনেক ভবন মালিককে সতর্ক করা হয়েছে।




    No comments

    Post Top Ad

    ad728

    Post Bottom Ad

    ad728